নিউজ ডেস্ক :: প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু থেকে কেউ পালাতে পারবে না। তাই মুমিন মুসলমানরা মৃত্যুর জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকে। মৃত্যুর মাধ্যমেই দুনিয়ার জীবনের সমাপনী আসে এবং আখেরাতের অনন্ত-অসীম জীবনের সূচনা হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যেখানে যে অবস্থাতেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই।
যদি তোমরা মজবুত দুর্গের মধ্যে অবস্থান করো, তবুও।’ (সুরা নিসা ৭৮) তাই সর্বাবস্থায় আমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করা উচিত। কারণ কখন যে কার মৃত্যুর ডাক চলে আসে আমরা কেউই সেটা জানি না। আমাদের কাছে সেটা অজানা থাকলেও তাকদিরে সে ক্ষণ ও মুহূর্ত ঠিকই নির্দিষ্ট করা আছে। সবাই তাকদিরে লিখিত সুনির্দিষ্ট সময়েই মৃত্যুবরণ করবে।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কারও মৃত্যু হতে পারে না। কেননা তা সুনির্ধারিত।’ (সুরা আলে ইমরান ১৪৫) আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তাদের নির্ধারিত সময় এসে যাবে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারবে না এবং বিন্দুমাত্র সময় এগিয়েও নিতে পারবে না।’ (সুরা ইউনুস ৪৯)
মৃত্যুর স্বাদ : আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।’ (সুরা আলে ইমরান ১৮৫) যে ব্যক্তি দুনিয়াতে সৎভাবে জীবনযাপন করেছে, মৃত্যুর পেয়ালা তার কাছে মিষ্টি মনে হবে। এর বিপরীতে যে ব্যক্তি অসৎভাবে জীবনযাপন করেছে, তার জন্য মৃত্যু এত তেতো হবে যে, তা পান করা তার জন্য কষ্টকর হবে। কিন্তু কিছু করার নেই, এরপরও এটি তাকে পান করতে হবে।
জীবন-মৃত্যু সৃষ্টির কারণ : পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মাটি থেকেই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, আর মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব এবং মাটি থেকেই তোমাদের ফের বের করে আনা হবে।’ (সুরা তাহা ৫৫) এ আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষের জন্ম, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের বিষয়টি একসঙ্গে তুলে ধরেছেন।
যাতে মানুষ একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে ভুলে না যায় কিংবা প্রাধান্য না দেয়। প্রতিটি মানুষের জীবনেই এ তিনটি পর্যায় আসবে। আর মানুষ এর প্রতিটি পর্যায়ই অতিক্রম করবে। মানুষের জন্ম, মৃত্যু ও পুনরুত্থান যদি সফলভাবে সম্পন্ন হয় তবেই মিলবে মুক্তি।
আল্লাহ দুনিয়ার জীবন দিয়েছেন দুনিয়ার সব কিছু আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় পালন করার জন্য। আর একজন মানুষ আল্লাহর নির্দেশ মেনে এসব জিনিস কতটুকু পালন করেছে তা পরীক্ষা করার জন্য মৃত্যু দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা মুলক ২)
মৃত্যুর রহস্য : মৃত্যু ভয়ংকর বিষয় হলেও এতে রহস্য আছে। মৃত্যুর মাধ্যমে কর্মের প্রতিফলন স্বরূপ পুরস্কার ও শাস্তি দেওয়া হবে। যদি মৃত্যুই না হতো, তাহলে নেককার লোকরা তাদের সাধনা, অধ্যবসায় ও মেহনতের পুরস্কার কীভাবে পেত? আর জালেম ও খুনিরা তাদের অপকর্মের শাস্তি কীভাবে পেত? মৃত্যু সবকিছু সহজ করে দিয়েযদি মৃত্যু না হতো তবে এর অধিবাসী দিয়ে দুনিয়া ভরে যেত। আজ পৃথিবীতে প্রায় আট বিলিয়ন মানুষ বাস করছে আর এতেই হট্টগোল গুরু হয়ে গেছে। যদি পৃথিবীর জনসংখ্যা আটশ বিলিয়ন হতো তাহলে পরিস্থিতি কী হতো?
মৃত্যুকে স্মরণ করা : ইসলাম মৃত্যুকে স্মরণ করে পরবর্তী জীবনের পরিণতি চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ ছাড়া সেসব মানুষের নিন্দা করেছে, যারা মনে করে মৃত্যুর পর আর কোনো জীবন নেই। রাসুল (সা.) বেশি বেশি করে মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে বলেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জীবনের স্বাদ হরণকারী মৃত্যুকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো।’ (জামে সুনানে তিরমিজি) আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, মুমিনদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান কে? তিনি বললেন, যারা মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য উত্তমরূপে প্রস্ততি গ্রহণ করে, তারাই সর্বাধিক বুদ্ধিমান।’ (ইবনে মাজাহ)
মৃত্যুর জন্য প্রস্ততি : মৃত্যু থেকে কেউ পলায়ন করতে পারবে না। আর কার মৃত্যু কোথায় হবে কিংবা কখন হবে, এ কথা কেউ জানে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘কেউ জানে না আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোথায় সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’ (সুরা লোকমান ৩৪) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে রজব আল হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি প্রাণীর প্রতিটি মুহূর্ত যেন তার মৃত্যুর মুহূর্ত।’
পাঁচটি জিনিসের মূল্যায়ন : রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিস আসার আগে গনিমত মনে করে মূল্যায়ন করো। সেগুলো হলো এক. যৌবনকে বার্ধক্যের আগে। দুই. সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে। তিন. সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের আগে। চার. অবসরকে ব্যস্ততার আগে। পাঁচ. জীবনকে মৃত্যুর আগে।’ (মুসতাদরাকে হাকিম)। এ বিষয়গুলোকে গনিমত (সম্পদ) মনে করার উদ্দেশ্য হলো, এ সময় বেশি বেশি নেক আমল করবে, সময়টা কাজে লাগাবে, খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকবে এবং ভালো কাজের দিকে অগ্রসর হবে। সময়ের সবচেয়ে উত্তম ব্যবহার হলো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করা, ইলম অর্জন করা, কোরআন তেলাওয়াত, সকাল-বিকেল জিকির, হালাল রুজির জন্য চেষ্টা, সৃষ্টির সঙ্গে উত্তম ব্যবহার এবং তার প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত থাকা।
মুমিন মুসলমান সব সময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করে। আবার কোনো ব্যক্তি যদি বুঝতে পারে যে, তার মৃত্যু আসন্ন, তবে তার উচিত আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকা। পরকালের অনন্ত জীবনের কথা স্মরণ করে নিজেকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করা। যারা জীবন সায়াহ্নে এসে উপস্থিত হয়েছে অথবা কোনো কারণে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে, আবার বয়স হওয়ার কারণে হলেও মৃত্যুর প্রহর গুনছে, তাদের উচিত মৃত্যুর পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। জীবনের বাকি সময়টুকু নিজের জন্য অমূল্য সম্পদ মনে করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার চেষ্টা করা এবং বিগত জীবনের গুনাহ মোচনে প্রাণপণ চেষ্টা করা উচিত।
মুমিনের করণীয় : মৃত্যুর স্মরণার্থে মুমিনের যে কাজগুলো বেশি বেশি করা প্রয়োজন তা হলো, ক্ষমাশীল ও দয়ালু মহান আল্লাহর কাছে নিজের অতীত জীবনের সব গুনাহের কথা তুলে ধরে সকাতরে তওবা ও ইস্তেগফার করা। বিগত জীবনের অপরাধ ও গুনাহের জন্য ক্রটি-বিচ্যুতিগুলোকে যথাসাধ্য অধিক পরিমাণে নফল ইবাদত-বন্দেগি ও নেকির কাজ দ্বারা ভরপুর করে দেওয়া। কোরআন অধ্যয়ন, উত্তম জিকির, দোয়া ও তাসবিহ-তাহলিলের মাধ্যমে দিন-রাত অতিবাহিত করা। বিশেষ করে তাওহিদের কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর জিকিরে জবানকে সিক্ত করা। পরকালের প্রথম মনজিল কবর। হাশরের ময়দানের ভয়াবহতা ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তির ভয়ে মহান আল্লাহর কাছে বেশি করে কান্নাকাটি করা এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। সব সময় পবিত্র তথা ওজু অবস্থায়
থাকা। কারও সঙ্গে লেনদেন থাকলে তা থেকে দ্রুত মুক্ত হওয়া। ঋণ থাকলে তা থেকেও মুক্ত হওয়া। বিগত জীবনে কারও হক বা অধিকার নষ্ট করে থাকলে, তা যদি স্মরণে থাকে তাহলে তার সঙ্গে বসে সমাধান করে নেওয়া কিংবা তার থেকে দায়মুক্তি গ্রহণ করা জরুরি। ন্যূনতম কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে বা জুলুম-অত্যাচার করলে তার থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। কারও কোনো ন্যায্য দাবি থাকলে তা পূরণ করা জরুরি। যে কারও যৌক্তিক দাবি-দাওয়া বা অভিযোগ থাকলে গুরুত্বের সঙ্গে তাও সমাধান করে নেওয়া। পরকালের নাজাতের নিয়তে বেশি বেশি দান-সদকা করা। তবে এ দান যেন কোনো ব্যক্তির মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি না হয়। কেননা মোট সম্পদের তিন ভাগের এক ভাগের বেশি দান করার ব্যাপারে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পরিবারের সদস্য ও সব উত্তরাধিকারীদের মৃত্যু-পরবর্তী বিষয়ে সতর্ক করা, অসিয়ত করা এবং তাদের জীবনযাপনে ইসলামি দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাওয়া জরুরি।