সরিষার হলুদে রাঙা উপকুলীয় জনপদ কয়রার মাঠ

রিয়াছাদ আলী, কয়রা :: মাঠের পর মাঠ হলুদে একাকার। উপর থেকে দেখলে মনে হয় পুরো মাঠ ছেয়ে আছে হলুদের চাদরে। শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকিয়ে উঠেছে চারপাশ। তা ঘিরে মৌমাছি ও বাহারি রঙের সব প্রজাপতির ছোটাছুটি।
পৌষের শেষ ভাগে শীতের শুষ্কতায় এ রকম হলুদের গালিচা মোড়ানো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখে যে কারও মন ও চোখ জুড়ায়। মাঝে সরলরেখার মতো সরু মেঠো পথ। পথের দুপাশে দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত সরিষা ফুলের সারি। কুয়াশা ভেদ করে বয়ে চলা মৃদ হাওয়ায় দোল খাওয়া সরিষার মাঠকে যেন মনে হচ্ছে ঢেউ খেলা হলুদ সমুদ্র। দুর্যোগ প্রবনতা উপকুলীয় জনপদ খুলনার কয়রা উপজেলার কাটমারচর গ্রামের বিলে সোমবার বিকেলে এমন চোখজুড়ানো দৃশ্য দেখা গেছে।
গত সোমবার সরেজমিনে সরিষা জমিতে গিয়ে দেখা যায়, পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদে সরিষা ফুলগুলো বাতাসে দোল খেতে থাকে। ফুলগুলো তাদের কলি ভেদ করে সুভাস ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে। এ যেন প্রকৃতির অপর সৌন্দর্যের লীলাভূমি। আর ছুটি কিংবা অবসর সময়ে শত শত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছুটেছে এ অঞ্চলে। ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষ, শিশুসহ বিনোদন প্রেমিরা। সরিষা মাঠ ঘুরে ঘুরে দেখছেন তারা। কেউবা আবার এমন দৃশ্য ধারণ করতে চলছে আইফোনে সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা। কয়রার কপোতাক্ষ নদ সংলগ্ন কাটমারচর গ্রামের বিলে ১৫০ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন ৫৮ জন কৃষক। হলুদ সরিষা ফুলের অবারিত সৌন্দর্য এখন লুটোপুটি খাচ্ছে বিলজুড়ে। কৃষকরা বলেন, সরিষা চাষে খরচ কম ও পরিশ্রম দুটোই কম হয়। তেলের দামও তুলনামূলক ভাল। উত্তরবেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সরদার বলেন, ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কপোতাক্ষ নদের বেঁড়িবাঁধ ভেঙ্গে লবণপানি প্রবেশ করেছিল গ্রামটিতে। এক বছরের বেশি সময় লবণপানির নিচে ডুবে ছিল পুরো কাটমারচর গ্রাম। পরে নদের বেঁড়িবাঁধ সংস্কার হলে কিছু মানুষ চেয়েছিল বিলের জমিতে লোনাপনি তুলে চিংড়ির ঘের করতে। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন ধান চাষের।
সেই থেকে বিলে চাষাবাদ শুরু। এরপর গত বছর একজন কৃষক আমন ধান কাটার পর এক বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করেছিলেন। ফলন ভালো হওয়ায় এবার সবাই ঝঁুকে পড়ে দেড় শ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। কাটমারচর বিলে নিজের ৪ (চার) বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন কৃষক মোশারাফ হোসেন। তিনি বলেন, বিলটিতে তারা আমন ধানের বাইরে কখনও কোনো ফসলের চাষ হতে দেখেননি। লবণাক্ত ও পানির সমস্যার কারনে তিনি কখনও অন্য ফসলের চাষ করার চেষ্টা করেনি। এবার প্রথমবারের মতো কৃষি গবেষণা ইনন্সিটিউটিটের পরামর্শে বারি ১৪ ও ২০ জাতের সরিষা চাষ করেছেন। তারা তাকে বিনামূল্যে বীজ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রথম দিকে অনিশ্চয়তা থাকলেও এখন বেশ ভাল ফুল ধরেছে। আশা করা যাচ্ছে, ভাল ফলন হবে। এ জনপদের আরেক এলাকা বাগালী ইউনিয়নের উলা গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান বলেন, জমি ফেলে না রেখে বাড়তি ফসল হিসেবে গত বছর আমি ১ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করে ৩ গুন লাভ হয়েছে। তাই এবার ৩ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করছি।
প্রতি বিঘায় যদি ৬ মন করে সরিষা উৎপাদন হয় তাহলে খরচ বাদ দিয়ে আমি ভালই লাভ পাব। সার, কীটনাশক তেমন লাগে না, খরচ অনেক কম আশা করছি এইবারও দ্বিগুন লাভবান হবো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এমএলটি সাইট কয়রার বৈজ্ঞানিক সহকারি জাহিদ হাসান বলেন, কাটমারচর এই মাঠে কৃষক দুই থেকে তিন বিঘার মত জমিতে সরিষা লাগাত কিন্তু এ বছর এ বিলে ২০০ থেকে ২৫০ বিঘা সরিষা চাষ হয়েছে। তার মধ্যে আমরা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সরেজমিন গবেসণা বিভাগ পার্টনার প্রকল্পের আওতায় ১৪৫ বিঘা জমিতে বারি সরিষা ১৪, ১৭ ও ২০ জাতের বীজ দেওয়া হয়েছে। এই সব জাত দেওয়ার মূলত কারন হলো এই মাঠটিতে ২ টি ফসল হয় একটা আমন ও বোরো এর মধ্যবর্তী সময়ে একটি ফসল পেতে পারে তার জন্য স্বল্পমেয়াদী কম সময় ও কম খরচে জাতের বীজ দেওয়া হয়েছে। বারি সরিষা ১৪ এর মেয়াদ ৭৫ দিন, বারি ১৭ এর মেয়াদ ৮০ দিন এবং বারি ২০ এর মেয়াদ ৮০ দিন। বারি সরিষার ফলন হয় ৩ থেকে ৪ মন আর বারি সরিষা ২০ এর ফলন হয় ৬ থেকে ৭ মন। তাহলে কৃষক যদি বারি সরিষা ২০ চাষ করে তাহলে অনেক বেশি লাভবান হবে। সাথে সাথে কয়রার দুই ফসলী জমিকে তিন ফসলি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম বলেন, সরিষা চাষ শুধু অর্থনৈতিক সুবিধাই আনছে না, বরং এটি মাটির উর্বরতা বাড়াতেও সাহায্য করে। ফসলের ঘনঘন চক্রের ফাঁকে চাষ করা এ ফসল চাষিদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে। সরিষার এই কেবল কৃষকদের জন্যই নয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে।
কয়রায় আমন ধান ঘরে তোলার পর বোরো চাষের আগে জমি পতিত থাকত। তাই এবারই প্রথম আমরা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সরেজমিন গবেষণা বিভাগ উদ্ভাবিত জমিতে শর্ট ডিউরেশন সরিষা ১৪৫ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেছি। সরিষা ক্ষেতের হলুদ গালিচা কয়রার সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপশি কৃষকদের নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।
« কয়রায় ক্ষুদ্র নৃ -গোষ্ঠীদের মাঝে হাঁস-মুরগীর খাদ্য বিতরণ (পূর্ববর্তী সংবাদ)
(পরবর্তী সংবাদ) বিআরটিএ ও ডামের উদ্যোগে ৭২৩ গণপরিবহণ চালককে প্রশিক্ষণ »
সম্পর্কিত সংবাদ

আনুলিয়া ইউনিয়নে ১০৩২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ, ১৪৩১ হেক্টরে মৎস্য চাষ হবে
★ মৎস্য ঘের প্রস্তুতে সার মিলছে না ★ রাস্তার দুরাবস্থায় সার নিয়ে ট্রাক যেতে আপত্তিবিস্তারিত…

আশাশুনিতে পারিবারিক মডেল পুষ্টি বাগান প্রদর্শনীর উপকরণ বিতরণ
জি এম মুজিবুর রহমান, আশাশুনি :: আশাশুনিতে বসতবাড়িতে পারিবারিক মডেল পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রদর্শনীর উপকরণবিস্তারিত…