এ খাতটিই দক্ষিণ কোরিয়ার বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ আর্থিক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকগুলোর হাতে থাকার পরও দেশের এসএমই খাত ধুঁকছে বিনিয়োগের অভাবে। জিডিপিতে এ খাতটির অবদান মাত্র ২০ শতাংশ। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে অবদান রাখা তো আকাশ-কুসুম কল্পনা, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও চায় তাদের গুঁড়িয়ে দিতে।
কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানও এ ব্যবসায় নেমেছে। তারা আমাদের নানাভাবে চাপে রাখছে। আমাদের ব্যবসা কমিয়ে দেওয়ারও হুমকি দিচ্ছে।’ দেশের শিল্প উৎপাদনের প্রতি মাসে তথ্য দিয়ে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাদের তথ্যই বলছে, উৎপাদনের অধিকাংশ সূচকই নিম্নগামীই নয়, ঋণাত্মক ধারায় গিয়ে ঠেকেছে। এতে প্রভাব শুধু ছোটদের ওপরই পড়েনি, উৎপাদন বাড়াতে বড়দের হিমশিম খেতে হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়ার অর্থ হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কমে গেছে, ফলে কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে।
অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) উদ্যোক্তাদের উৎপাদনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তাদের উৎপাদন সূচক ছিল ১৯৮ দশমিক ৯৪, সেটি চলতি বছর জুনে কিছুটা বেড়ে ২১৮ দশমিক ৯৬ পয়েন্টে উঠেছে। তবে এক মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ জুলাই শেষে উৎপাদন সূচক আবার নেমে দাঁড়ায় ১৯৮ দশমিক ২৫ পয়েন্টে। অর্থাৎ এক বছর আগের অবস্থানের চেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে এমএসএমই উৎপাদন।
একই অবস্থা কুটির শিল্পেও। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এ খাতের উৎপাদন সূচক ছিল ১৯৮ দশমিক ৯৯ পয়েন্ট, এ বছরের জুলাইয়ে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯৫ দশমিক ৭১ পয়েন্টে। তবে বিপরীত অবস্থান বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সূচক। গত বছরের একই সময়ে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন সূচক ছিল ১৯৬ দশমিক ৫৬ পয়েন্টে, এবার একই সময়ে তা ২০৩ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট ছাড়িয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি এ প্রসঙ্গে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের ৯০ ভাগ প্রতিষ্ঠানই কুটির শিল্প। ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ না দিয়ে বড়দের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি উৎসাহী। ছোটরা না বাঁচলে দেশের অর্থনীতিও বাঁচবে না। তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নতুন নতুন পদ্ধতি হাতে নিতে হবে।’
বিবিএসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যে দেখা যায়, জুন শেষে দেশের মোট কর্মসংস্থান কমেছে ১০ লাখ ৭০ হাজার। সবচেয়ে বেশি কমেছে সেবা খাতে, ১০ লাখ ৪০ হাজার। কৃষি খাতে কর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তি কমেছে ২ লাখ ৩০ হাজার। তবে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ২ লাখ। একই সময়ে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এটি গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার।
অর্থাৎ দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। দেশের ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ছোট ব্যবসায়ীদের হাতে উল্লেখ করে মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারিতে মোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৮ লাখ, সেখানে বড় শিল্পের সংখ্যা ৫ থেকে ৬ হাজার। দেশের মোট শিল্পের ৬৫ শতাংশই কুটির বা ক্ষুদ্র শিল্প। দেশের ৯০ শতাংশ বা তার বেশি সিএমএসএমই (কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি) শিল্প।
কিন্তু ব্যাংক খাত বড় শিল্পকে বেশি ঋণ দেয়, মধ্যম শিল্পকে কিছুটা দেয়। ক্ষুদ্র শিল্পকে তারা দিতে চায় না। এসব ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে মাইক্রোফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশনগুলো কিছু ঋণ দেয়, আবার তাদেরও অর্থ খুব কম।’ সিএমএসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ খরায় ভুগছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠান অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও ব্যাংকগুলো সাধারণত ওপরের দিকে থাকে, নিচের দিকে আসতে চায় না। কারণ এসব ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান অপ্রাতিষ্ঠানিক।
অর্থাৎ এদের রেজিস্ট্রেশন নেই, ট্যাক্স দেয় না, তাদের কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেই কেন নেই তারও যুক্তি আছে। কেউ যদি একবার ট্যাক্স দেয়, সংস্থাগুলো তাদের পেছনে লেগে থাকে। তাই কেউ ঝামেলায় পড়তে চায় না।’ হস্ত ও কারুশিল্প প্রতিষ্ঠান বিনাস ক্র্যাফটস অ্যান্ড ডিজাইনসের স্বত্বাধিকারী সাফিনা আক্তার ব্যবসা বাড়াতে এক সময় ব্যাংকের কাছে ঋণ চেয়েছিলেন। ব্যাংক তার কাছ থেকে নানান কাগজপত্র চাওয়ার পাশাপাশি বড় ধরনের জামানতও চেয়েছিল।
ব্যর্থ হয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জানতে চাইলে সাফিনা আক্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ছোটদের ব্যবসা করতে গেলে অনেক ধরনের বাধা পেতে হয়। বড়দের সঙ্গে ব্যবসায় টিকতে গেলে অনেক জনবলের প্রয়োজন হয়, সেটিও আমাদের নেই। ব্যাংকের কাছে ঋণ চাইতে গেলে নানান কাগজপত্র চায়, জামানতও চায়। আমাদের মতো ছোট প্রতিষ্ঠানের হাতে তা নেই।’
বাংলাদেশে অর্থনীতির ৫২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাংক খাত। গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লুটেরাদের নিয়ন্ত্রণে থাকার পর ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট এখন প্রকট।ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদ- আখ্যা দিয়ে বিশ^ব্যাংকের সাম্প্রতিক সময়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দেশের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় উৎস হওয়া সত্ত্বেও এখানে বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়তে হয় তাদের।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে ৬০ লাখের বেশি ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরে ৮০ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত, বাকি ৬ দশমিক ৪ শতাংশই মাঝারি মানের। প্রায় অর্ধেক এমএসএমই বিশ্বব্যাংককে জানিয়েছে, তাদের বিকাশ এবং বৃদ্ধি, তাদের ক্রেডিট বা ঋণপ্রাপ্তির হার সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
সীমিত জামানতের কারণে এ সমস্যাটি বিশেষত ছোট উদ্যোক্তা ও নারীদের নেতৃত্বাধীন এমএসএমইগুলোর জন্য তীব্র। ব্যাংকগুলো জামানত কম থাকার কারণে তাদের ঋণ দিতে আগ্রহী হয় না। ব্যাংকের মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। আবার এই ২৫ শতাংশের অর্ধেক দিতে হবে কুটির, মাইক্রো (অতিক্ষুদ্র) ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতে। মোট সিএমএসএমই ঋণের মধ্যে উৎপাদনশীল শিল্পে অন্তত ৪০ শতাংশ, সেবায় ২৫ শতাংশ এবং বাকি ৩৫ শতাংশ ব্যবসা উপখাতে বিতরণ করতে হবে।
নারী উদ্যোগে দিতে হবে অন্তত ১৫ শতাংশ। যদিও এ ক্ষেত্রে উৎপাদন ও সেবার তুলনায় ব্যবসায় বেশি ঋণ দিতে আগ্রহ দেখা যায়। ব্যাংকে আমানতের বড় একটা অংশ রাখেন এসব আমানতকারী। তবে সেই টাকা নামে-বেনামে কিংবা প্রভাব খাটিয়ে নিয়ে নেন বড় ব্যবসায়ীরা।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) এসএমই খাতে ৫৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৬২ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা।
এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ৮ হাজার ২২০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এই খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ১৩ শতাংশের বেশি। তবে গত প্রান্তিকের থেকে সামান্য বেড়েছে এই খাতে ঋণ বিতরণ। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে এই খাতে বিতরণ করা হয়েছিল ৫৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা।অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ও কর্মসংস্থানের জন্য সিএমএসএমইতে ঋণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ায় এসএমই খাত অনেক বড়।
তারা চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করে। কাজেই আমাদের মতো দেশগুলোতে আমরা যদি এ খাতকে গতিশীল না করতে পারি, তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে না, কর্মসংস্থানও হবে না।’তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র এ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকগুলো এদের বিভিন্ন কারণে ঋণ দিতে চায় না, অনেক কাগজপত্র চায়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যারা থাকে, তাদের তো এসব কাগজপত্র থাকে না।’
সিএমএসএমই খাতে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো বিভিন্ন পদ্ধতি বের করতে পারে জানিয়ে মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো মাইক্রোফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশনগুলোর মাধ্যমে দিতে পারে বা তারা নিজেরাও দিতে পারে। ঋণ ব্যবস্থাকে তারা আরও সহজ করতে পারে। ব্যাংকগুলোকে এদের কাছে যেতে হবে।’