হাসিনার স্বৈরশাসনে সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, সংস্কারের পর নির্বাচন
নিউজ ডেস্ক :: ক্ষমতা ধরে রাখতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলোর টেকসই সংস্কার জরুরি। আর এটি করতে হলে যৌক্তিকভাবেই সময়ের প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশবাসী সেই সময় দিবে এমনটা আশা করে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে টেকসই সমৃদ্ধির জন্য সবার দৃঢ় সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করেন।
গতকাল রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠনের প্রধানদের নিয়ে ওই ব্রিফিং হয়। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা নিজের দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি এবং চরম অব্যবস্থাপনার বিষয়েও কথা বলেন। ড. ইউনূস বিদেশি দূতদের বলেন, পরিস্থিতি ক্লোজ টু নরমাল, এটা পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থাতে ফেরানোই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায়োরিটি। তিনি বলেন, বিচার ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনে অনিয়ম আর দুর্নীতি সর্বত্র। সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে।ক্লোজডোর কূটনৈতিক ব্রিফিং শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
সংস্কার শেষে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হবে: বিদেশি বন্ধু উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস খোলাসা করেই বলেন, দেশের কাঠামোগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পর যত দ্রুত সম্ভব অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। বর্তমান সরকারের প্রধান কাজ যত দ্রুত সম্ভব একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এমনটা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তবে এর আগে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের আমূল সংস্কার করতে হবে, যার মধ্যদিয়ে ভোটের সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। প্রধান উপদেষ্টা ব্রিফিংয়ের সূচনাতে বলেন, বাংলাদেশের বন্ধুদের মধ্যে থাকতে পেরে আনন্দিত। দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। শেখ হাসিনার নৃশংস স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল লাখো বীর ছাত্র-জনতা। কিন্তু তার দলের ছাত্র সংগঠন ও শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেশে ভয়াবহতম বেসামরিক গণহত্যা করার পর শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। আমি সেই সমস্ত বীর ছাত্র এবং নিরীহ মানুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই, যারা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। আমাদের সামপ্রতিক স্মৃতিতে অন্য কোনো দেশের ছাত্রদের তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের জন্য এত মূল্য দিতে হয়নি; যেখানে একটি বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং পরিবেশবান্ধব দেশের স্বপ্ন দেখতে হয়েছে, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত থাকবে। দীর্ঘ দেড় দশকের নির্মম নৃশংসতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার দমন করা হয়েছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম তাদের ভোটাধিকারের চর্চা না করেই বেড়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট হয়েছে। আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুণ্ঠন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার।
তবে হ্যাঁ, দেশ নিয়ে ছাত্রদের একটি স্বপ্ন আমাদের মুগ্ধ করেছে, যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ছাত্ররা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে যেখানে মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে, নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কথা উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। সশস্ত্র বাহিনী বেসামরিক শক্তির সহায়তায় কাজ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিস্থিতি নিশ্চিত হবে। সব ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রধান উপদেষ্টা দেশে জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনে নিহত হওয়ার ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্তকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, তিনি চান এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। তদন্তে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ সরকার সহায়তা দেবে। ড. ইউনূস বিদেশিদের বলেন, বাংলাদেশ যতগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে, তার সব বাস্তবায়ন করবে সরকার। তিনি বলেন, নতুন যাত্রার এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের সাহসী ছাত্র ও জনগণের জন্য আমাদের জাতির স্থায়ী পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের যাত্রাটা কঠিন। তাদের আকাঙ্ক্ষা আমাদের পূরণ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা হয়, ততই ভালো। আমরা বিশ্বাস করি, একটি নতুন গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের যাত্রাপথে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সব বন্ধু ও অংশীদারেরা আমাদের সরকার ও জনগণের পাশে দাঁড়াবে।
ব্রিফিং শেষে গণমাধ্যমকে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ই আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। দায়িত্ব নেয়ার পর ড. ইউনূস প্রথমবারের মতো বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করলেন।শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা কূটনীতিকদের জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তার সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্ধৃত করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তে জাতিসংঘ তদন্ত দলকে স্বাগত জানিয়েছেন। ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা উল্লেখ করে তিনি কূটনীতিকদের বলেন, আমাদের নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। এই দেশের পুনঃনির্মাণের জন্য আপনাদের পূর্ণ সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। ছাত্র-জনতার প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ড. ইউনূস বলেন, তারা এমন এক বাংলাদেশ গড়তে সচেষ্ট, যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে, থাকবে বাকস্বাধীনতা, থাকবে মানবাধিকার। একইসঙ্গে জাতিগত নৃগোষ্ঠী, লৈঙ্গিক ও অন্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
গণমাধ্যম সংস্কার বিষয়ে ড. ইউনূস কূটনীতিকদের বলেন, শেখ হাসিনার সরকার মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন করেছিল। এখন গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র সমাজ ও জন-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে বলে জানান তিনি। ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই মুহূর্তে আর্থিক খাতে বড় অগ্রাধিকার হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক।
আমরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। তবে কেউ বৈশ্বিক পোশাক সরবরাহ কাঠামো বিঘ্নিত করার চেষ্টা করলে তা কোনোভাবে সহ্য করা হবে না বলে স্পষ্ট বার্তা দেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি এমন সময় দায়িত্ব নিয়েছি যখন দেশের অনেক কিছু চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল।
প্রেস সচিব জানান, প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি বন্ধুদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশ যত আন্তর্জাতিক চুক্তি করেছে, যত আইনি বাধ্যবাধকতা আছে সেগুলো মেনে চলা হবে
।
রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়াসহ মানবিক সাহায্য অব্যাহত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান ড. ইউনূস। ওই কূটনৈতিক ব্রিফিংকে নতুন সরকার প্রধানের সঙ্গে বিদেশি বন্ধুদের ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ বা শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় বলে উল্লেখ করেন প্রেস সচিব।
সম্পর্কিত সংবাদ
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ‘কালো মেঘ’ দূর করতে চায়
নিউজ ডেস্ক :: ঢাকা সফররত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে, বিভিন্নবিস্তারিত…
ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে সরানোর অনুরোধ প্রধান উপদেষ্টার
নিউজ ডেস্ক :: বাংলাদেশিদের জন্য ইউরোপের দেশগুলোর ভিসা সেন্টার ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায়বিস্তারিত…