নিউজ ডেস্ক :: হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তার জীবন ছিল খুবই অসাধারণ। আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ (সা.)-এর উত্তম চরিত্রের প্রশংসা করেছেন। তার চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কলম ৪) অন্যত্র মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে।
’ (সুরা আহজাব ২১) এ কারণেই মানুষকে উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহ তার প্রিয় রাসুলকে প্রেরণ করেছেন। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমাকে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমদ) হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানুষ ও জিন উভয় জাতির কাছে প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া ১০৭) কাজেই এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, মুহাম্মদ (সা.) শুধু আরব ভূখণ্ডের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন; বরং গোটা জগতের জন্য তিনি রহমতস্বরূপ।
তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের জীবন্ত উদাহরণ। চারিত্রিক সব ভালো গুণ তার মধ্যে ছিল। ক্ষমা, উদারতা, সহানুভূতি, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, সততা, সত্যবাদিতা, দয়া, দান-সদকা, কাজকর্ম, মানবতা ও মহত্ত্বে তিনি ছিলেন সর্বকালের সব মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। মুমিনদের প্রতি মুহাম্মদ (সা.) অতিশয় স্নেহশীল ও দয়ালু ছিলেন। মানবজাতি কোনো দুঃখ-কষ্টে পতিত হবে এবং আজাব-গজবে পড়বে, এটা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল এসেছেন। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে সহ্য করা দুঃসহ।
তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াময়।’ (সুরা তওবা ১২৮) বস্তুত আমরা নিজেকে যতটুকু ভালোবাসি, মুহাম্মদ (সা.) তার চেয়েও বেশি আমাদের ভালোবাসেন।হজরত সাদ ইবনে হিশাম ইবনে আমের (রা.) আয়েশা (রা.)-কে মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘কোরআনই তার মহান চরিত্রের পরিচয়।’ (সহিহ মুসলিম) অর্থাৎ কোরআন যা কিছুই বলেছে মুহাম্মদ (সা.) তা মেনেছেন, আর যা কিছু নিষেধ করেছে, তিনি তা বর্জন করেছেন।
কোরআন যা উত্তম বলেছে, তিনি তাই করেছেন। কোরআন যে কাজের প্রশংসা করেছে, যেদিকে আহ্বান করেছে, তিনি তা দিয়েই নিজেকে সাজিয়েছেন এবং যা মন্দ বলেছে, যা কিছু নিষিদ্ধ করেছে, তা তিনি বর্জন করার গৌরব অর্জন করেছেন। সুতরাং কেউ যদি রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্বন্ধে জানতে চায় তাহলে বলা যায় যে, তার চরিত্র ছিল হুবহু কোরআন অর্থাৎ কোরআন পড়ে তার চরিত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে নাও।আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর দিন-রাত মুহাম্মদ (সা.)-এর খেদমত করেছি।
এর মধ্যে আমি অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু তিনি কখনো আমাকে প্রহার করেননি, ধমক দেননি, কোনো দিন এ কথা বলেননি, এ কাজ তুমি কেন করেছ আর এ কাজ তুমি কেন করোনি?’ (সহিহ বুখারি) আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, মুহাম্মদ (সা.) কখনো অশ্লীল কথা বলতেন না, কাউকে অভিশাপ দিতেন না এবং অশোভন কিছু করতেন না। কারও ওপর অযথা রাগান্বিত হতেন না। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সেই ব্যক্তি, যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।
’ (সহিহ বুখারি) আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘মুমিন বান্দা সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে রোজাদার ও নামাজি ব্যক্তির মর্যাদা অর্জন করে নেয়।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কেয়ামত দিবসে আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে তারা, যারা তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। আর সবচেয়ে অপছন্দনীয় ও কেয়ামত দিবসে আমার থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী হবে তারা, যারা তোমাদের মধ্যে বাচাল, দাম্ভিক, অহংকারী ও হিংসুটে হয়।’
মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবতার নবী। তিনি ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে প্রবর্তন করেছিলেন মানবতার উজ্জ্বল নমুনা। ক্ষমা করতেন তিনি ঘাতক চিরশত্রুকেও। মুসলিম ও অমুসলিম সবার জন্য ছিলেন তিনি উদার। জীবনের শুরু থেকে আত্মনিয়োগ করেন জনসেবায়। বন্ধু-শত্রু সবার সঙ্গে তিনি অঙ্গীকার রক্ষা করতেন। আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষায় তিনি খুবই যতœবান ছিলেন এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও নমনীয় আচরণ করতেন।
মুহাম্মদ (সা.) সব সময় এতিম ও বিধবাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। তিনি দরিদ্র ও অসহায়দের সেবা করতেন। এছাড়া তিনি অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা শুশ্রƒষা করতেন। তার এ কাজ শুধু মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অসুস্থতায় তিনি এগিয়ে যেতেন। তাদের খোঁজখবর রাখতেন। তিনি বড়দের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল এবং ছোটদের প্রতি দয়ালু ছিলেন।মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বাধিক দানশীল।
জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কখনই এমন হয়নি যে, কেউ তার কাছে কিছু চেয়েছেন অতঃপর খালি হাতে ফিরে গিয়েছেন বা রাসুল (সা.) অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।’ (সহিহ বুখারি) তিনি রমজান মাসে বেশি দান করতেন। তিনি স্বভাবগতভাবে গম্ভীর প্রকৃতির ও চুপচাপ ছিলেন। অর্থপূর্ণ বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। যদিও আরবের সব ভাষাই তিনি জানতেন। তার প্রকাশভঙ্গি ছিল সুস্পষ্ট এবং অপ্রয়োজনে কথা বলতেন না।
তিনি এমন কথাই শুধু মুখে আনতেন যে কথায় সওয়াব লাভের আশা থাকত। তিনি যখন কথা বলতেন তখন মনে হতো যেন মুখ থেকে মুক্তা ঝরছে। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন সবাই মনোযোগ সহকারে তা শুনতেন।মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বাধিক কোমল প্রাণের অধিকারী এবং নিরহংকারী। বিনয় ও নম্রতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বাধিক লাজুক প্রকৃতির। লজ্জাশীলতা ও আত্মসম্মান এত প্রবল ছিল যে, দৃষ্টি সর্বদা নিচু করে রাখতেন।
আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন পর্দানশীন কুমারী মেয়ের চেয়েও অধিক লজ্জাশীল। কোনো কিছু তার পছন্দ না হলে চেহারা দেখে বোঝা যেত।’ (সহিহ বুখারি) তিনি নিজের জীবন থেকে তিনটি বিষয়কে সম্পূর্ণ দূর করে দিয়েছিলেন। তা হলো পরস্পর কূটতর্ক করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা এবং লক্ষ্যহীন কোনো কিছুর পেছনে লেগে থাকা। অন্য লোকদের ক্ষেত্রেও তিনি তিনটি বিষয়ে সংযমী ছিলেন। কাউকে মন্দ বলতেন না, কাউকে দোষারোপ করতেন না এবং কারও অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকতেন না।
যে কথা মানুষের কল্যাণকর তাই বলতেন। মোটকথা সর্বোত্তম আদর্শের সমাহার ছিল তার জীবনে। মুহাম্মদ (সা.) নিজে যেমন উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিলেন ঠিক তেমনি অন্যদের উত্তম চরিত্রবান হওয়ার নির্দেশনা দিতেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনদের মধ্যে তার ইমান পরিপূর্ণ, যার চরিত্র সর্বোৎকৃষ্ট এবং যে তার স্ত্রী-পরিবারের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল।’ (সুনানে তিরমিজি) তিনি ছাড়া জগতের আর কোনো মানুষের মধ্যে একসঙ্গে এতগুলো চারিত্রিক গুণের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়নি।
তাই শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিম পণ্ডিতরা পর্যন্ত তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। বিখ্যাত জার্মান লেখক ও দার্শনিক কবি জোহান গ্যাটে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘ইতিহাসের পাতায় আমি তন্নতন্ন করে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ মানুষের দৃষ্টান্ত খুঁজেছি, অবশেষে তা পেয়েছি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে।’ ঐতিহাসিক মাইকেল এইচ হার্ট বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রে সর্বাধিক সফল ছিলেন।’
জর্জ বার্নার্ড শো আরও সুন্দর করে বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কেউ যদি গোটা বিশ্বের শাসনভার পরিচালনা করেন, তবে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।’বিশ্বের সব মানুষের আদর্শ হিসেবে তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ ছিল সবার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। শিক্ষিত ও উন্নত জাতির জন্য এমন আদর্শের প্রয়োজন। সুতরাং মুসলিম নারী-পুরুষ সবাইকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শের অনুসারী হতে হবে।
পৃথিবীর সব মানুষ ও সবকিছুর ওপর তার আদর্শকে স্থান দিয়ে সেই অনুযায়ী জীবন চালাতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে নবী, লোকদের বলে দিন, তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান ৩১)