নিউজ ডেস্ক :: গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি বড় দল হিসেবে নিজের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি জানান দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গত দেড় দশক আন্দোলন করে আসা দলটিকে কোনোভাবেই যে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, তা আওয়ামী লীগের আমলেও জানান দিয়েছে দলটি।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ইস্যু ঘিরে বিএনপির অবস্থানও বলছে, বিএনপিকে বাদ দিয়ে বড় কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। নির্বাচন ও সংস্কারের প্রশ্নেও দলটি তার প্রত্যাশা স্পষ্ট করেছে। দলটির নেতারা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, ততটা সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হোক। অন্য যেসব সংস্কার সেটা নির্বাচিত সরকার করবে। বিএনপির নিজেরও ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি রয়েছে।
যদিও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন পর্যন্ত কতদিনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া হবে বা কীভাবে নির্বাচন হবে, সেরকম কোনো রোডম্যাপ দেয়নি। সংস্কার প্রক্রিয়া কী হবে—সেটাও খোলাসা করেনি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সহিংসতার জের ধরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সূত্রপাত। এর ধারাবাহিকতায় গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর তিন দিন পর ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের দুজন নেতা রয়েছেন।
সরকার গঠনের পর ছাত্রদের সমর্থনে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। যে কারণে সরকার ছাত্রদের দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করা হচ্ছিল। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই বলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। এরপর তার পদত্যাগের ইস্যুটি সামনে আসে। গত মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবি জানায়।
একইদিন বঙ্গভবন ঘেরাও করে আরও কয়েকটি সংগঠন। পরদিন বুধবার বিএনপির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে এসে বিএনপি নেতারা সাংবাদিকদের বলেন, এই মুহূর্তে কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি হোক, সেটা তারা চান না। এরপর দৃশ্যপট পাল্টে যায় অনেকটা। রাতেই ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন।
ছাত্রনেতারা ও অন্তর্বর্তী সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে পিছিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা বলেন। অবশ্য ওইদিন রাতে ছাত্র আন্দোলনের আরেকটি দাবি মেনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেছেন বিএনপি নেতারা।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানানো হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এরপর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যু চলে যায় আলোচনার টেবিলে। সেই আলোচনায় এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে বলা যায়, রাষ্ট্রপতির অপসারণের ক্ষেত্রে বিএনপি সাংবিধানিক সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে চাচ্ছে না।
গত শুক্রবার জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ছাত্রনেতারা বৈঠক করেন। জামায়াত বলেছে, রাষ্ট্রপতি অপসারণে তারা নীতিগতভাবে একমত। কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য দরকার।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে সংলাপে ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল ও জোট একই মতামত দিয়েছে। অর্থাৎ বিএনপির মতামত যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও স্পষ্ট হয়েছে তাদের বক্তব্যে।
দ্বিতীয় দফায় গত শনিবার ছাত্রনেতারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বিএনপি বলেছে, তারা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে জানাবে। তবে দলটি ইতিমধ্যে এই ইস্যুতে গত সপ্তাহের বুধ ও বৃহস্পতিবার রাতে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ফ্যাসিবাদের ‘প্রোডাক্ট’ হলেও তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বড় ধরনের সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে, যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে পারে।
গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতি অপসারণে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, সাংবিধানিক সংকট, রাষ্ট্রীয় সংকট, রাজনৈতিক সংকট তৈরির পেছনে কী শক্তি আছে, সেটা আগে পর্যালোচনা করা দরকার। এর আগে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে তারা কিছু করতে নারাজ। বরং রাষ্ট্রপতি ইস্যুর চেয়ে তারা জরুরি মনে করছেন নির্বাচন অনুষ্ঠান।
অর্থাৎ, নির্বাচনের তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণা। রাষ্ট্রপতি ইস্যু কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা কিংবা সাংবিধানিক সংকট তৈরি হলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে বলে বিএনপির নেতাদের আশঙ্কা। বিএনপি দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। তাদের কথার বাইরে গিয়ে কিছু করলে সেটি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে—রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে এ বিষয়টিও অন্তর্বর্তী সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের কাছে বিএনপি পরিষ্কার করতে চেয়েছে।
বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়াবে না বিএনপি। বরং দ্রুত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করবে। দলটির শীর্ষ মহল মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সংস্কার এবং আগামী সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দ্রুত না দেওয়ায় একের পর এক ইস্যু নতুন করে সামনে আসছে।
এতে করে নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ইতিমধ্যে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও দলটির সিদ্ধান্ত রয়েছে, সেই ফাঁদে পা না দেওয়ার এবং ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা এর আগেও বলেছি, গণঅভ্যুত্থানের যে ফল, সেই ফলাফলের ফসল ঘরে তুলতে; বাংলাদেশে বিপ্লবকে সুসংহত করতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য।
কোনোরকম হঠকারী পদক্ষেপ না করে একটা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সব কাজ করার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।’নির্বাচন বিলম্ব হলে সংকট প্রকট হবে বলে মনে করেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এটা নিয়েও আমরা বারবার বলছি, নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করে অতি দ্রুত একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। একমাত্র সেটাই সব সংকট নিরসন করতে পারে।
তাই যত দ্রুত সম্ভব নিরপেক্ষভাবে সাধারণ নির্বাচন করা দরকার এবং একটা সাংবিধানিক রাজনৈতিক শক্তির দেশের দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা দরকার।’বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ছয়টি কমিশন সংস্কারের কাজ করছে। সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি সময় দেওয়ার কথা বলছে। তবে দলটির নেতারা এটাও বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দ্রুত সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা।
তারা আরও বলছেন, সংস্কার ও নির্বাচনী কার্যক্রম একই সঙ্গে চলতে পারে। নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির দিক থেকে সরকারকে সবসময় চাপে রাখার সিদ্ধান্তও রয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই বিএনপি তার আগামী দিনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে চায়।নির্বাচন ইস্যুতে দলটির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গত শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে এক সভায় বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।
কিন্তু মূল সমস্যা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য বিষয়ের দিকে নজর দিচ্ছে তারা। তারা যা কিছু করুক, নির্বাচনের দ্রুত রূপরেখা তৈরি করুক। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য জনগণ অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করবে না।’শনিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এক কর্মসূচিতে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘এ সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেবে। এর মধ্যে সংস্কারের যে কথাগুলো উঠেছে সেই সংস্কার করবে। কিন্তু কথা হলো, সেটা তারা কতদিনে করবে?’
গতকালও এই ইস্যুতে প্রায় একই মতামত দিয়ে বিএনপির একাধিক নেতা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন।ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বাংলাদেশ এলডিপির প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, “বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ঘোলাটে করার জন্য একটা ‘প্রগতিশীল চক্র’ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার ইঙ্গিত বহন করে বঙ্গভবনের সামনে মিছিল। নতুন করে আরেকটা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির চক্রান্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি।”
ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকার সার্চ কমিটি গঠনের তোড়জোড় শুরু করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিদ্যমান আইনে সার্চ কমিটি করা হবে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের পর তারা নির্বাচন-সংক্রান্ত কাজ শুরু করবে।এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরাও বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। কারণ এটি সেই পুরনো ফর্মুলা।
তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) এতে নতুন কী যোগ করে, সেটা আগে দেখতে হবে। তাদের কর্মপরিকল্পনা দেখে আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরব।’অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিএনপির কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা চাইলে আমরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত তুলে ধরতে পারতাম।’রাষ্ট্রপতি অপসারণ, সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান ও রাজনীতিতে দলটির প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানস চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির মতামত বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মানে গত ৩০-৪০ বছরের রাজনীতিতে। লক্ষ করুন, বিএনপি সংসদে থাকলে আদৌ শেখ হাসিনা সরকারের এ পরিণতিই হতো না বা সম্ভাবনা কম ছিল।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টা ৫ আগস্টেই হতে পারত, হওয়ার দরকার ছিল এবং রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করেই।
কিন্তু সেটা ঘটেনি বলে এখন সম্ভব নয় তাও নয়। আমি বিএনপির অবস্থানকে ওই সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হিসেবেই দেখতে পাই। যদি বলেন, তাহলে কৌশল বদলেছে অভ্যুত্থানে বিজয়ী শিক্ষার্থীপক্ষ। এতে পরস্পরের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে, তাও আমি মনে করি না। হয়তো আলাপ দরকার, বিগত আমলে যেটার অভাব ছিল।’