প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া  রোধে  করনীয়

মোঃ সোহাগ আলম ::
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার ভিত্তি । শিক্ষার ভিত মজবুত না হলে সেই শিক্ষা বাস্তবমুখী বা টেকসই হয়না। তাই বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বিদ্যমান।
কিন্তু সার্বজনীন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে কোন শিক্ষার্থীই যেন ঝরে না পড়ে সেদিকে শিক্ষক, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটি, জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আশার কথা হচ্ছে কোন কোন উপজেলায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবে সমতলীয় অঞ্চলের চেয়ে নদীভাঙ্গন, হাওড়, বাওড়, উপকূলবর্তী ও পাহাড়ী অঞ্চলে এবং অনগ্রসর এলাকায় ঝরে পড়ার হার অপেক্ষাকৃত বেশি।
ঝরে পড়া কী?
ঝরে পড়া বলতে বোঝায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুরা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাচক্র শেষ হওয়ার পূর্বেই মধ্যবর্তী যে কোনো সময়ে যে কোনো শ্রেণি থেকে যদি বিদ্যালয় ত্যাগ করে লেখাপড়া ছেড়ে দেয় অর্থাৎ শিক্ষাচক্র শেষ না হতেই যেসব শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ত্যাগ করে তাদেরকে বোঝায়।
ঝরে পড়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য কারণগুলো হলো:-
দারিদ্র্যতা, অভিভাবকের অসচেতনতা, শিশুর যত্নের ঘাটতি, মেয়ে শিশুকে শিক্ষা না দেয়ার প্রবণতা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, অসুস্থতা, ভাষার সমস্যা, বিদ্যালয় ও শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, শিক্ষক স্বল্পতা, দুর্বল শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা, প্রধান শিক্ষকের দক্ষতা, শ্রেণি শিক্ষকের পাঠদান আনন্দদায়ক না হওয়া, শিশুর শারীরিক ও মানসিক শাস্তি, শিক্ষাক্রমের অসংগতি, বিদ্যালয়ের সময়সূচি, বিদ্যালয়ের ভৌত সুবিধাদি, সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম, বিদ্যালয়ের দূরত্ব, যাতায়াত ব্যবস্থা, নিরাপদ পানীয় জল ও শৌচাগারের সুব্যবস্হা না থাকা, নিষ্ক্রিয় এসএমসি, পিটিএ, শিক্ষক অভিভাবক সম্পর্ক ও সমন্বয়হীনতা, দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ টেকসই ও কর্মমুখী শিক্ষাক্রম ব্যবস্থা এবং একীকৃত শিক্ষা বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা, স্কুল ভীতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ঝরে পড়া রোধ করার জন্য স্থানীয় জনসমাজের সম্পৃক্ততা স্টেক হোল্ডারদের আন্তরিকতা অতীব জরুরি। বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে যেসব বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায় সেগুলো হলো- শিশু জরিপ, শতভাগ ভর্তি, ছাত্র ও শিক্ষকের নিয়মিত উপস্থিতি, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৃক্ষরোপণ, বিদ্যালয়ের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও বিষয় পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক স্বল্পতা দূরীকরণ, স্থানীয়ভাবে উপকরণ সংগ্রহ ও তার ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা, মা সমাবেশ ও অভিভাবক সমাবেশ, স্লিপ স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সভার আয়োজন করা ইত্যাদি।
ঝরে পড়া রোধে সমাজ সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা হচ্ছে- অভিভাবকদের সচেতন করা, শিশুদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ করা, দরিদ্র শিশুদের জন্য শিক্ষা উপকরণ, স্কুলড্রেস ইত্যাদির ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করা, বিদ্যালয়ে খেলাধুলাসহ নিয়মিত সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা নিরাপদ রাখা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, বিষয় বিশেষজ্ঞ প্যারা শিক্ষকের ব্যবস্থা করা, গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, মিড-ডে মিল বাস্তবায়ন করা, ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিরাপদ স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা, মেয়েদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া, বিদ্যালয়ের জন্য সম্পদ সংগ্রহ করা ও তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা, নিয়মিত বিদ্যালয়ের খোঁজখবর রাখা। এছাড়াও স্কুল ভীতি দূরীকরণের লক্ষ্যে সরকারের সুদূরপ্রসারী প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মতভাবে বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক।
আশার কথা হচ্ছে ঝরে পড়া রোধে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝরে পড়ার হার অনেকাংশে কমে গিয়েছে।
ঝরে পড়া রোধে সরকার যে সকল ব্যবস্হা নিয়েছেন সেগুলো হলো, বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকা ভিত্তিক শিশু জরিপ পূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা, নিয়মিত মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও হোম ভিজিট কার্যক্রম, বছরের প্রথম দিন শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ, মিড ডে মিল চালুকরণ, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুসারে প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্লীপ ফান্ডে সরকারীভাবে বরাদ্দ, যা শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন মুলক নানা  কাজে ব্যবহার করা হয়, তাছাড়াও খেলাধুলা সহ নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পরিচালনা করতে সরকার কর্তৃক নির্দেশনা জারীর কারণে নিরাপদ ও আনন্দদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিশুদের ঝরে পড়া অনেকাংশে কমেছে।
এমতাবস্থায় রাষ্ট্র, সমাজ, জনপ্রতিনিধিরা এবং স্টেক হোল্ডারগণ নিজ অবস্থান থেকে বিদ্যমান কার্যক্রমগুলো নীতিমালা অনুযায়ী  সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ঝরে পড়ারোধ ধীরে ধীরে শুন্যের কোঠায় নামিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন।