হিজড়া ও আইনী অধিকার

শেখ আলমগীর আশরাফ :: বিউটি একজন হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) নারী যিনি একটি বিউটি সেলুনে কাজ করেন। একদিন রাতে, যখন সে কাজ থেকে বাড়ি যাচ্ছিল, তখন সে রাস্তার এক কোনেমদ্যপপানকারী চার জনের একটি দল দাঁড়িয়ে ছিল। বিউটিকে দেখে, পুরুষের দলটি তার দিকে বাঁশি বাজিয়ে তাকে ডাকে, যা বিউটি উপেক্ষা করে।

একজন লোক তার পিছনে দৌড়ে তার চুল টেনে ধরে।অন্য পুরুষরা তাকে মারধর করতে শুরু করে। তারা তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে এবং পরে নগ্ন অবস্থায় তাকে মাঠে ফেলে রেখে যায়।

পরের দিন, বিউটি তার সাথে করা অপরাধের রিপোর্ট করতে থানায় যায়। উপস্থিত কর্মকর্তা তাকে বলেছিলেন যে তিনি একজন নারী না হওয়ায় ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন না।

আপনি কি ভাবেন?

আলোচনাঃ
• হিজড়াকে?
• হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার কি এক?
• ধর্ষণ ও সংশ্লিষ্ট আইন।
• অপরাধটি আইনে বর্ণিত ধর্ষণের সংগার আওতায় কিনা?
• অপরাধটি অন্য কোন আইনে বর্ণিত অপরাধের আওতায় আসে কিনা।
• আইনের অস্পষ্টতা।
• প্রাসঙ্গিক আলোচনা।
• শেষ কথা।

কে হিজড়া?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমজমের ত্রুটির কারনে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের জন্ম পরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়। অস্পষ্ট বাহ্যিক প্রজনন অঙ্গ নিয়ে জন্মায়। হিজড়া সাধারণতঃ ৩ ধরনের। কোন কোন হিজড়ার শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য পুরুষের মত, লিঙ্গ আছে কিন্তু ক্ষুদ্র, মুত্র নিঃসরণ ঘটে, যৌন কর্মে অনুপযোগী আবার কোন কোন হিজরার শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নারীর মত, যোনী ছিদ্র অছে কিন্তু ক্ষুদ্র, মুত্র নিঃসরণ হয়, যৌন কর্মে অনুপযোগী। আবার কোন হিজরা আন্তঃলিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে জন্মায়, তবে সেই সংখ্যা খুবই কম।

হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার কি এক?

দেশের প্রধান মিডিয়াসহ বিশ্বমিডিয়া হিজরাদেরকে ট্রন্সজেন্ডার হিসাবে প্রচার করে থাকে। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজরা এক নয়। জেন্ডার আইডেন্টিটি হচ্ছে এক ধরনের অন্তনির্হিত বিশ্বাস বা অনুভূতি বা মানসিক অবস্থা। যদি এট জন্মগত লৈংগিক পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্য হয় তবে তাকে সিসজেন্ডর বলে। যদি এই মানসিক অনুভূতি জন্মগত লিঙ্গের সাথে অমিল হয় তবে তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলে।তিন ভাবে ট্রান্সজেন্ডারে রুপান্তর হওয়া যায়-

(ক) মেডিকেল রুপান্তর- হরমোন ট্রিটমেন্ট এবং বিভিন্ন ধরনে সার্জারি করে অবয়ব পরিবর্তন করা হয়। প্রায় সকল ক্ষে্ত্রে যৌনাঙ্গ (পেনিস বাযোনী) অক্ষত থাকে, শরীরের উপরের অংশ যেমন মুখাবয়ব, স্তন, শারীরিক কমনীয়তা ইত্যাদি পরিবর্তন করা হয়।

(খ) আইনগত রুপান্তর- জন্ম সনদে সেক্স আইডেন্টিটি পরিবর্তন করে জেন্ডার আইডেন্টিটি গ্রহন,ন্যাশনাল আইডি কার্ড, পাশপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, সোস্যাল সিকিউরিটি রেকর্ড, ব্যাংক একাউন্টে নাম পরিবর্তন করা হয়।

(গ) সামাজিক রুপান্তর- নামের পরিবর্তন, নতুন সম্বোধন, বেশভূষা পরিবর্তন, মেকাপ শুরু করা বা বাদ দেয়া, মেয়েদের অলংকার পরিধানু করা বা বাদ দেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবার , বন্ধু-বান্ধব, কলিগদের শুধু জানানোর মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার হওয়া যায়।

ধর্ষণ ও আইনঃ

দন্ডবিধির৩৭৫ধারাতে ধর্ষণ (Rape) এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে।এখানে বলাহয়েছে,কোননারীকেতারইচ্ছারবিরুদ্ধেতারসম্মতিব্যতীতঅথবাভয়দেখিয়েসম্মতিআদায়করেঅথবাঅন্যায়ভাবেবুঝিয়েতারসম্মতিনিয়েযৌনসহবাসকরলেসেটানারীধর্ষণনামেবিবেচিতহবে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন,২০০০ এর ৯ ধারার ব্যাখ্যাতে নারী ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।এখানে বলা হয়েছে,কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত১৬hছরেরঅধিকবয়সেরকোননারীরসাথেতারসম্মতিছাড়াবাভীতিপ্রদর্শনকরেবাপ্রতারণামূলকভাবেতারসম্মতিআদায়করেযৌনসঙ্গমকরাকেনারীধর্ষণবলে।নারীওশিশুনির্যাতনদমনআইনের৯(১) ধারায়বলাহয়েছে, যদিকোনপুরুষকোননারীবাশিশুকেধর্ষণকরেন, তাহলেতারশাস্তিহবেমৃত্যুদন্ডবাযাবজ্জীবনসশ্রমকারাদন্ডএবংঅর্থদন্ডে।

অপরাধটি আইনে বর্ণিত ধর্ষণের সংগার আওতায় কিনা?
কোন একটি কাজ তখনই অপরাধ বলে গন্য হবে, যখন কাজটি সংঘঠিত হলে আইনে শাস্তির বিধান থাকবে। ভিকটিম বিউটি নারী বা শিশু কোনটি না হওযায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘঠিত কজটি দন্ডবিধি বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বর্ণিত ধর্ষনের অপরাধের আওতাভূক্ত নয়।দন্ডবিধির ধর্ষনের সংগা অনুসারে ধর্ষণের স্বীকার ব্যক্তিকে নারী হতে হবে। নারীওশিশুনির্যাতনদমনআইন অনুসারে ধর্ষনের স্বীকার ব্যক্তি অবশ্যই নারী বা শিশু হতে হবে।

অপরাধটি অন্য কোন আইনে বর্ণিত অপরাধের আওতায় আসে কিনা?
দন্ডবিধির৩৭৭ধারাতে. প্রকৃতিবিরুদ্ধঅপরাধ ও তার শাস্তি বর্ণিত হয়েছে।কোনব্যক্তিযদিস্বেচ্ছায়কোনপুরুষ, নারীবাপশুর সাথেপ্রকৃতিরনিয়মেরবিরুদ্ধেযৌনসঙ্গমকরে, তবেতাকেযাবজ্জীবনকারাদন্ডঅথবাদশবছরপর্যন্তযে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডেদন্ডিত হবে, তদুপরি অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে।

দন্ডবিধির৩৭৭ধারা অনুসারে ভিকটিমে হবে কোন ‍পুরুষ বা নারী বা পশু।ভিকটিম পুরুষ বা নারী বা পশু কোনটি না হওয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘঠিত কজটি দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় বর্ণিত প্রকৃতিবিরুদ্ধঅপরাধের আওতাভূক্ত নয়।

আইনের অস্পষ্টতাঃ

হিজড়াদের যৌন নির্যাতন করা হলে সেটি ধর্ষণ নাকি বলাৎকার সে বিষয়টি পরিস্কার নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নারী ও শিশুদের প্রতি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের বিষয় বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা এ ধরণের পরিস্থিতিতে কী করবেন, কার কাছে বিচার চাইবেন তা নিয়ে কোন আইনেই কিছু বলা নেই।

প্রাসঙ্গিক আলোচনাঃ
আবার, শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নারীর মত নয় বরং শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য পুরুষের মত এমন একজন হিজড়ার প্রতি একজন স্বাভাবিক পুরুষের ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নমূলক কাজ করার অভিযোগ উঠল। সে ক্ষেত্রে পুরুষের মত শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট হিজড়া ব্যক্তিটি দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বা নারীওশিশুনির্যাতনদমনআইন,২০০০এর৯ ধারায় বা ১০ ধারায় কোন প্রতিকার পাচ্ছেনা।

আবার,ট্রান্সজেন্ডার, যারা আইনগত বা মেডিকেল বা সামাজিক রুপান্তরের মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডারে পরিণত হয়েছে, তাদের প্রায় সকল ক্ষে্ত্রে যৌনাঙ্গ (পেনিস বা যোনী) অক্ষত থাকে, শরীরের উপরের অংশ যেমন মুখাবয়ব, স্তন, শারীরিক কমনীয়তা ইত্যাদি পরিবর্তন করা হয়। এদের প্রতি যেমন ধর্ষনের মত অপরাধ বা যৌন নিপীড়নের মত অপরাধ সংঘটিত হতে পারে, তেমনি এদের দ্বারা ধর্ষন বা যৌন নিপীড়নের মত অপরাধ সংঘঠিত হতে পারে।

উচ্চআদালতএকটিমামলায় [আব্দুসসামাদ (মো.) বনামরাষ্ট্রওঅন্যান্য, ১৯বিএলসি (২০১৪) ১৭১] দণ্ডবিধির৩৭৫ধারারস্পষ্টকিছুবলানাথাকলেওছেলে শিশুকেবলাৎকারেরঅপরাধধর্ষণহিসেবেগণ্যহবেবলেমতদিয়ে বলেন-যেহেতু১৬বছরেরকমবয়সীএকটিশিশুযৌনমিলনবাসমকামিতায়সম্মতিজানাতেপারেনা, তাইকোনোপুরুষকর্তৃকসম্মতিসহকারেকোনোছেলেশিশুরসঙ্গেসমকামিতাওনারীওশিশুনির্যাতনদমনআইনের৯ (১) ধারারঅধীনশাস্তিযোগ্যধর্ষণেরআওতাভুক্তহবে।
ছেলেশিশুরমতোই১৬বছরেরঅধিকবাপ্রাপ্তবয়স্ককোনোপুরুষওধর্ষণেরমত অপরাধের শিকারহতেপারে।ধর্ষণেরবর্তমানসংজ্ঞাঅনুযায়ীএকজনপ্রাপ্তবয়স্কপুরুষঅপরপুরুষবানারীরদ্বারাধর্ষণেরশিকারহলেতিনিধর্ষণেরমামলাকরতেপারেননা।সংজ্ঞায়হিজড়া, রূপান্তরিতনারী (ট্রান্সজেন্ডার)বাপুরুষধর্ষণেরবিষয়েকোনোকথাবলাহয়নি।নারীওমেয়েশিশুরমতোছেলেশিশুওপ্রাপ্তবয়স্কপুরুষওযেধর্ষণেরশিকারহতেপারেন, সেটারআইনিস্বীকৃতিদিয়েছেযুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহবেশকয়েকটিদেশ।কিন্তুআমাদেরএখানেএখনোএধরনেরকোনোস্বীকৃতিনেই।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েগেজেটে এই জনগোষ্ঠীকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন রাষ্ট্রীয়ভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ৈ হিজরাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়, নগিরিকত্ব সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার বাধা দূর হয়। কিন্তু সংবিধান স্বীকৃত কিছু আইনী অধিকার পেলেও যৌন নির্যাতনের মত ঘটনায় আইনী প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই হিজরাদের উপর যে কোন যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের প্রতিকারের বিষয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত বলে মনে করি।প্রকাশ থাকে যে, অধিকাংশ মানুষ হিজড়াকে ট্রান্সজেন্ডারের সমার্থক মনে করেন। যে কারো সন্তান জন্মগত ত্রুটির কারনে হিজড়া হয়ে জন্ম নিতে পারে। এদের সামাজিকরণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকার হিজড়াদেরকেই তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়াছে। হিজড়ারা সমাজে অত্যন্ত অবহেলিত। ধর্মীয় দিক থেকে হিজড়াদের পাশে দাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব।হিজরাদের পড়লেখা, আবাস, কর্মসংস্থান তৈরীতে পদক্ষেপ গ্রহন করে তাদেরকে দক্ষ জনবল করে তুলতে হবে। আইনের মা্ধ্যমে হিজড়াদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, হিজড়ার নামে ট্রান্স জেন্ডারিজম যেন না হয় সে দিকে সচেতন হতে হবে।

শেষ কথাঃ
নারীর মত ছেলেশিশু, প্রাপ্তবয়স্কপুরুষ ও হিজড়ারাও যে ধর্ষন ও যৌননিপীড়নের স্বীকার হতে পারেন হতেপারেন সেই কথা বিবেচনায় রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সংশোধন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি একজন নারী কর্তৃক কোন পুরুষকে ও হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার কর্তৃক কোন হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার বা পুরুষ বা নারীকে ধর্ষণ বা যৌননিপীড়নের বিষয়টিও বিবেচনায় রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সংশোধন করা প্রয়োজন।

• আলোচনার বিভিন্ন জায়গায় ‘ধর্ষন’ শব্দের পরিবর্তে ‘ধর্ষণের মত অপরাধ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কারন অপরাধটি বাংলাদেশের কোন আইনে ধর্ষন হিসাবে বর্ণিত বা সঙ্গায়িত নেই।

লেখকঃ শেখ আলমগীর আশরাফ, এডভোকেট, জজ কোর্ট, সাতক্ষীরা।






সম্পর্কিত সংবাদ

  • সাবেক এমপি জাহের কারাগারে ১০০ টাকায় সাপ্লাই দিতেন ১০ টাকার ওষুধ
  • বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা, চার্জশিটভুক্ত আসামি গ্রেফতার
  • ফের রিমান্ডে সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হক
  • স্থল বন্দরের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও পরিচালক রেজাউল করিমের নামে যশোর আদালতে মামলা
  • সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী গ্রেপ্তার
  • বিএনপির যে নেতা আটক হলেন যৌথ বাহিনীর অভিযানে
  • আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হলেন তাজুল ইসলাম